ভেটো না দিয়ে অপেক্ষা করুন | ইসলামী প্রবন্ধ |
ভেটো না দিয়ে অপেক্ষা করুন।
মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আরিফি
এক বক্তার কথা মনে পড়ছে, তিনি বাকশিল্প নিয়ে কথা বলছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ইউসুফ আলাইহিস সালামের কিচ্ছা থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করলেন। যখন তিনি কুরআনের এই আয়াতে পৌছলেন-
وَدَخَلَ مَعَهُ السِّجْنَ فَتَيَانِ ۖ قَالَ أَحَدُهُمَا إِنِّي أَرَانِي أَعْصِرُ خَمْرًا ۖ وَقَالَ الْآخَرُ إِنِّي أَرَانِي أَحْمِلُ فَوْقَ رَأْسِي خُبْزًا تَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْهُ
তার সঙ্গে জেলখানায় প্রবেশ করল দুই যুবক। (একদিন) তাদের মধ্য থেকে একজন এসে বলল, আমি (স্বপ্নে) দেখছিলাম যে আঙুর নিংড়াচ্ছি। আরেক জন (এসে) বলল, আমি (স্বপ্নে) দেখছিলাম যে, মাথায় রুটি বহন করছি। পাখি সেখান থেকে খাচ্ছে। সূরা ইউসুফ: ৩৬
তখন তিনি শ্রোতাদের প্রতি নজর বুলালেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, ইউসুফের সাথে কি দুই যুবক জেলখানায় প্রবেশ করেছিল। আগে প্রবেশ করেছিল কে? ইউসুফ, না কি যুবকদ্বয়?
একজন শ্রোতা চিৎকার দিয়ে বলল, ইউসুফ।
আরেক জন বলল, না, না; যুবকদ্বয়।
তৃতীয় জন বলল, না, না; বরং ইউসুফ... ইউসুফ।
চতুর্থ জন চাতুর্য প্রকাশ করে বলল, তারা একসাথে প্রবেশ করেছিল।
পঞ্চম জনও কিছু একটা বলল। এরপর শুরু হল হৈ চৈ এবং মূল আলোচ্যবিষয় হারিয়ে গেল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, বক্তা ইচ্ছা করে এই পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। শ্রোতাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন তিনি। সময় গড়িয়ে যেতে থাকল। এরপর তিনি মুচকি হাসলেন এবং নীরব হওয়ার জন্য ইশারা করলেন। তিনি বললেন, সমস্যা কী? হয়তো ইউসুফ যুবকদের আগে প্রবেশ করেছিলেন, অথবা তারা ইউসুফের আগে প্রবেশ করেছিল। এই বিষয়টি কি এতটা বিরোধের দাবি রাখে?
যদি নিজেদের সম্পর্কে চিন্তা করি, তা হলে দেখতে পাব আমরা অনেক সময়ই অন্যের বক্তব্যের উপর অধিক আপত্তি করে বোঝা সৃষ্টি করি। ফলে কোন একজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গল্প বলা শুরু করে; কিন্তু আরেক জন আকস্মিক আপত্তি করে ছেদ সৃষ্টি করে এবং গল্পের মাধুর্যটাই নস্যাৎ করে দেয়। এমনসব আপত্তিই সাধারণত করা হয়, গল্পের সাথে যেগুলোর কোন সামঞ্জস্য নেই।
হাঁ, সবকিছুর উপর আপত্তি করে নিজেকে অন্যের জন্য বোঝা বানাবেন না। মনে পড়ছে, আমার ভাই সাআদের বয়স যখন ছিল সাত বছর, তখন সে একবার মসজিদে গেল এশার নামায পড়তে। মনে হয় তার খুব তাড়া ছিল; কিন্তু ইমাম সাহেব নামায পড়াতে আসতে বিলম্ব করছিলেন। তার যখন তর সইছিল না, তখন সে মুআযয্যিনের দিকে অগ্রসর হল। মুআযযিন ছিলেন বুড়ো মানুষ। তিনি কানে কম শুনতেন। সাআদ তার পিছনে দাঁড়িয়ে নাকে হাত রেখে কণ্ঠ পরিবর্তন করে বলল, ইকামত বলুন। এরপর দৌড়ে পালাল।
মুআযয্যিন ওকথা শুনে ইকামত বলার জন্য তৎপর হলেন। কোন এক মুসল্লী বিষয়টি তাকে অবগত করে থামিয়ে দিলেন। মুআযযিন বসলেন। গোস্বায় লাল হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। তিনি হয়তো মনে মনে বলছিলেন, ছোকরাটারে যদি একবার পাই রে...।
ঘটনাটি ছিল খুব অদ্ভূত। কিন্তু আমি একে গুরুত্ব দেওয়ার মত কোন কারণ পেলাম না। তবে একবার আমি এক মজলিসে বসেছিলাম। তখন একজন গল্পটি বয়ান করলেন। তিনি মাঝখানে একথাও বললেন যে, সাআদের তাড়া ছিল। কারণ, তার বাবার সাথে তার সাগরপাড়ে যাওয়ার কথা ছিল।
লোকটি একথাও জানতেন যে, রিয়াদ শহর মরু অঞ্চলে অবস্থিত এবং আশপাশে কোন সাগর নেই। আমি ভাবতে লাগলাম- আমি কি আপত্তি করে তার গল্পে ছেদ সৃষ্টি করব? না কি এই তথ্যটুকু গল্পের উপর খুব একটা বিরূপ প্রভাব ফেলবার মত নয় এবং সেজন্য আপত্তি করে শত্রুতা পয়দা করারও সমীচীন নয়? আমি দ্বিতীয় চিন্তাকে প্রাধান্য দিলাম এবং নীরব হয়ে গেলাম।
আপনি অনেক সময় এমন বিষয়ের উপর আপত্তি করে থাকেন, যার সম্পর্কে আপনার মোটেও ধারণা নেই। হয়তো কোন অসুবিধা আছে; কিন্তু আপনি তাকে ভর্ৎসনা করছেন।
যিয়াদ একজন নেককার ছেলে। মানুষকে কল্যাণের উপদেশ করার মানসিকতা আছে তার। একদিন তার গাড়ি একটি চৌরাস্তায় এসে থামল। আচানক তার কানে ভেসে এল বিদেশী গানের প্রকট আওয়াজ। কোত্থেকে আসছে এই আওয়াজ- একথা ভেবে সে হতভম্ব হয়ে গেল। চারদিকে নজর বুলিয়ে অনুসন্ধান করতে লাগল সে। হঠাৎ সে বুঝতে পারল পাশের গাড়ি থেকেই গানের সেই আওয়াজ ভেসে আসছে এবং গাড়ির চালক লাউড স্পিকারের সর্বোচ্চ আওয়াজ দিয়ে গান বাজাচ্ছে। আওয়াজ পৌঁছে যাচ্ছে দূরের ও কাছের সবার কানে।
যিয়াদ ভেপু বাজাতে লাগল, চালককে গানের আওয়াজ কমানোর জন্য। কিন্তু লোকটি ফিরেও তাকায় না; আওয়াজও কমায় না। যিয়াদের কাছে মনে হতে লাগল গানের মধ্যে অধিক মগ্ন থাকার কারণে লোকটি চারপাশের কোনকিছু শুনতে পাচ্ছে না।
চালকের চেহারা দেখার জন্য যিয়াদ সচেষ্ট হল। তার চেহারার দুপাশে পড়েছিল রুমাল। বেশ চেষ্টা করার পর চালকের চেহারা দেখতে পেল যিয়াদ। দেখল লোকটির মুখে যথেষ্ট পরিমাণে দাড়ি আছে। এতে তার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল- এমন অবয়বের লোক কুরআন শোনার পরিবর্তে গান শুনছে? তা-ও এমন প্রকট আওয়াজে?
চৌরাস্তার সবুজ বাতি জ্বলে উঠল এবং ছুটে চলল সব গাড়ি। লোকটিকে উপদেশ করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হল যিয়াদ। তার পিছনে চলতে লাগল সে।
আগের গাড়ির লোকটি একটি দোকানের পাশে গিয়ে থামল এবং জরুরী কিছু কেনার জন্য গাড়ি থেকে নামল সে। যিয়াদও তার পিছনে গাড়ি থামাল এবং তাকে পরখ করতে লাগল। লোকটির পরিধেয় কাপড় সংক্ষিপ্ত। তবে মুখে দাড়ি পরিপূর্ণ। যিয়াদের মনে ওয়াসওয়াসা দেখা দিল। সে মনে মনে ভাবতে লাগল, লোকটি হয়তো গাড়ি থেকে নেমেছে সিগারেট কেনার জন্য।
লোকটি দোকান থেকে বের হয়ে এল। দেখা গেল, তার হাতে একটি ইসলামী ম্যাগাজিন। যিয়াদ আর সবর করতে পারল না। বিনম্রভাবে ডাকতে লাগল সে, এই যে ভাই! শুনুন।
লোকটির কোন উত্তর নেই। ফিরেও তাকাল না সে। যিয়াদ আওয়াজ বুলন্দ করল, ভাইজান! ও ভাইজান। একটু এদিকে লক্ষ করুন।
লোকটি হন হন করে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসল। কোন দিকে ফিরে তাকাল না সে। যিয়াদ গাড়ি থেকে নামল। রাগে ফেটে পড়ার মত অবস্থা তার। এগিয়ে গিয়ে বলল, এই যে ভাইজান! আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিন। আপনি কি শুনতে পান না?
যিয়াদের দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটি। তারপর গাড়ির দিকে মনোযোগ দিল। আবার চড়া আওয়াজে গান ছেড়ে দিল। এবারে যিয়াদ উত্তেজিত হয়ে গেল। বলল, আরে ভাই! এ তো আপনার জন্য হারাম। আপনি মানুষকে বিরক্ত করছেন।
লোকটি আবারও হাসল। গান চলছে আগের মত তীব্র আওয়াজেই। যিয়াদ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। লাল হয়ে গেল তার চেহারা। লোকটিকে শোনাবার জন্য চিৎকার দিতে লাগল সে। তারপর যখন গাড়ির লোকটি বুঝল যে, বিষয়টি বহু দূর গড়িয়েছে, তখন সে হাত দিয়ে কানের দিকে ইশারা করে ঝাড়া দিল। তারপর পকেট থেকে ছোট্ট একটি কার্ড বের করল। সেটার প্রথম পৃষ্ঠায়ই লেখা ছিল, আমি একজন বধির; শুনতে পাই না। আপনি কী বলতে চান, দয়া করে সেটা লিখে দিন।
লক্ষণীয়:
আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
وَكَانَ الْإِنْسَانُ عَجُولًا.
মানুষ ত্বরিতপ্রবণ। সুরা ইসরা:১১
সুতরাং সতর্ক হোন। আপনার ত্বরিতপ্রবণতা যেন আপনার চিন্তাশীলতাকে অতিক্রম না করে।