কথার যাদুকর হোন – ইসলামে সুন্দর বাক্যের গুরুত্ব ও প্রভাব
প্রিয় নবীর (সা.) কথা বলার নমুনা
'কথা বলতে তো কোনো পয়সা লাগে না। তাই মিষ্টি কথা বলুন।'
এমন শব্দেই জনৈক স্ত্রী তার স্বামীকে তিরস্কার করছিলো। স্বামী তার স্ত্রীর উপাদেয় অন্ন, রুচিশীল বস্ত্র ও সুন্দর বাসস্থান দিতে কোনো ত্রুটি করেনি ঠিক; কিন্তু সে স্ত্রীকে মিষ্টি কথা বলে কখনো মুগ্ধ করেনি।
মিষ্টি কথা দিয়ে ক্রেতাকে মুগ্ধ করা একজন দক্ষ সেলসম্যান ও বিক্রেতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিক্রেতার কথা যত সুন্দর হবে তার মূল্য ততই বেশি হবে। আর সুন্দর ব্যবহারের সঙ্গে যদি পণ্যের গুণগত মানও ভালো হয় এবং ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করার পারদর্শিতাও থাকে তাহলে তো বলাই বাহুল্য। একেই তো বলে 'সোনায় সোহাগা'।
অভিজ্ঞজনদের মত হলো, একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির যেসব গুণ থাকা উচিত সেসবের অন্যতম হচ্ছে- আকর্ষণীয় উপস্থাপনা ও মিষ্টি ভাষা। মানুষ যেন তার কথা শুনেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সে কথায় কথায় বলবে: 'জ্বি স্যার, ঠিক আছে। আপনার জন্য আর কী করতে পারি? আমরা তো আপনার সেবায় নিয়োজিত ইত্যাদি।
অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী যেমন কৃপণ, তেমন অসুন্দর। তারপরও স্ত্রী তার প্রতি সন্তুষ্ট, বরং বলা যায় আসক্ত। কারণ, স্বামী কথার যাদু দিয়ে তাকে মুগ্ধ করে রেখেছে।
কৈশোরের গণ্ডি এখনো পার হয়নি এমন এক যুবকের কথা আমি জানি। সে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে খুব চুটিয়ে প্রেম করতে দক্ষ ছিল। মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো আশ্চর্য ক্ষমতা ছিলো তার। কত তরুণী যে তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে তার হিসাব নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মেয়েদেরকে প্রলোভন দেখানোর মতো ছেলেটির কাছে অত্যাধুনিক কোনো গাড়ি ছিল না। পছন্দসই উপহার দেয়ার মতো মানিব্যাগ ভর্তি টাকাও ছিল না। এমনকি রাজপুত্রের মতো আকর্ষনীয় চেহারাও ছিল না। কিন্তু তার ছিলো কথাবলার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। এমন মধুর কথা সে বলতে পারতো যা শুনলে পাথরও গলে যেতো।
কথার যাদু দিয়ে সে তরুণীদের শিকার করতো। তরুণীরা তার পিছে ঘুরঘুর করতো।
সিরাত ও ইতিহাসের পাতা উল্টালে একটি আশ্চর্য ঘটনা পাওয়া যায়।
একবার রাসূল-এর দরবারে তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত হলো। কায়েস বিন আসেম, যাবারকান বিন বদর ও আমর বিন আহতাম। তিনজনই বনু তামীম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
তারা প্রত্যেকেই রাসূল-এর সামনে নিজের প্রশংসা করতে লাগলো। প্রথমে যাবারকান বললো, 'আল্লাহর রাসূল! আমি বনু তামীম গোত্রের সরদার। বনু তামিমে আমি একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। আমি তাদের অধিকার রক্ষায় সচেতন।'
এটুকু বলে সে আমর বিন আহতামের দিকে ইশারা করে বললো, 'এ আমর আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে।'
আমরও তার কথার সমর্থন করে বললো, 'সত্যিই হে আল্লাহর রাসূল! ইনি অনেক প্রভাবশালী। অনেক ক্ষমতাবান। সভা-সমিতিতে সবাই তার সিদ্ধান্ত একবাক্যে মেনে নেয়।'
এটুকু বলেই আমর ক্ষ্যান্ত হলো। প্রশংসায় সে অতিরঞ্জন করলো না। যাবারকান আমরের মুখ থেকে আরো কিছু শোনার আশা করছিলো। আমরের সুসংক্ষিপ্ত মন্তব্য তাকে ক্ষুদ্ধ করলো। তার মনে হলো, আমর সম্ভবত তার নেতৃত্ব সহ্য করতে পারছে না। এ কারণে সে হিংসার বশবর্তী হয়ে প্রশংসার ক্ষেত্রে এত কৃপণতা করেছে!
তাই সে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠল, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আমর আমার ব্যাপারে হিংসার বশবর্তী হয়ে সে অনেক কিছু গোপন করেছে।'
এ কথা শুনে আমরও খুব রেগে গেলো। সে বললো, 'আমি আপনার প্রতি হিংসা করব কেন?! আল্লাহর শপথ! হে যাবারকান, তুমি তোমার বোন ও তাদের সন্তানদের সাথে নির্মম আচরণকারী, নতুন ধনী, এক নির্বোধ পিতার সন্তান ও কবিলার পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী।'
এরপর আমর রাসূল-কে উদ্দেশ্য করে বললো, 'আল্লাহর রাসূল! আমি শুরুতে যা বলেছি, তাও সত্য; এখন যা বলেছি, তাও অসত্য নয়।
তবে আমার স্বভাব হলো- কাউকে ভালো লাগলে তার ভালো গুণগুলো বলে বেড়াই। আর কেউ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে তার দোষ ত্রুটি গোপন রাখি না।'
রাসূল তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, বর্ণনার দৃঢ়তা ও ভাষার সৌকর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, 'কিছু কিছু কথা যাদুর মতো প্রভাবশালী।'
(মুসতাদরাকে হাকিম: ৬৬৪৫)
তাই প্রিয় পাঠক! আপনিও হোন প্রিয়ভাষী, মিষ্টিভাষী ও সুবচনা।।
কেউ এসে যদি আপনাকে বলে, 'ভাই! আমাকে একটা কলম দিন।' আপনি তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে হাসিমুখে বলুন, 'জ্বী ভাই! নিন।'
কেউ যদি আপনাকে বলে, 'ভাই, আমার একটা কাজ আছে, করে দিবেন?' তাহলে আপনি বলুন, 'অবশ্যই, অবশ্যই! বলুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি।' 'আপনি তো অনেক বড় মানুষ। আপনার পায়ের সমানও নয় এমন কত মানুষের কাজ করে দিয়েছি।'
মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব সবার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ও কোমল ভাষায় কথা বলুন। এতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না; বরং অন্যরা মুগ্ধ হবে, তাদের মনে দ্বিধা বা সংশয় থাকলে তা দূর হবে।
হুনাইন যুদ্ধের পর আনসারদের অবস্থা লক্ষ করুন।
আনসাররা রাসূল-এর সঙ্গে থেকে প্রতিটি জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। জিহাদের প্রতিটি আহ্বানে হাসিমুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বদরপ্রান্তরে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন। ওহুদ প্রান্তরে কঠিন পরিস্থিতিতেও রণক্ষেত্রে টিকে ছিলেন। খন্দক যুদ্ধে শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়েও হতাশ হননি। মক্কাবিজয়ের অভিযানেও তারা ছিলেন সবার আগে। মক্কাবিজয়ের পর মুসলমানরা হুনাইন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
বুখারী ও মুসলিমের ভাষ্যে বর্ণিত সে যুদ্ধের একটি ঘটনা।
সামরিক কলাকৌশল ও অস্ত্র-শস্ত্রের দিক থেকে প্রতিপক্ষ ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। শুরুতেই যুদ্ধ প্রচণ্ড রূপ ধারণ করলো। শত্রুবাহিনীর আকস্মিক ও কৌশলী আক্রমণে মুসলিমবাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো এবং রাসূল ট্রি-কে নিঃসঙ্গ রেখে পেছনে ফিরে গেলো। মুসলমানদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল।
রাসূল সাহাবীদের দিকে তাকালেন। তার চোখের সামনে দিয়েই সকলে দৌড়ে পালাচ্ছে। রাসূল দিলেন, 'হে আনসারগণ!' উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজ
রাসূলের আহবানে সকলে 'লাব্বাইক' বলে সাড়া দিলেন। সাথে সাথে ফিরে এলেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন রাসূল-এর সামনে। শত্রুবাহিনীর প্রতিটি আঘাত ফিরিয়ে দিলেন ততোধিক আঘাতে। রাসূল-এর জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিলেন।
এবার কাফেররা পালাতে লাগলো। মুসলমানরা বিজয়ী হলেন।
যুদ্ধশেষে রাসূল-এর সামনে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ একত্র করা হলো। আনসাররা নীরবে তাকিয়ে থাকলেন। তাদের কারো কারো স্মৃতির এ্যালবামে ভেসে উঠলো মদীনায় রেখে আসা ক্ষুধার্ত পরিবার ও সন্তানদের মুখচ্ছবি। অনেকে এই যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে পরিবারের অভাব দূর হওয়ার মতো অংশ পাওয়ার আশা করছিলেন।
এমন সময় রাসূল আকরা ইবনে হাবিস আল-কে ডাকলেন। তিনি কিছুদিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। রাসূল তাকে একশত উট দিয়ে দিলেন। এরপর আবু সুফিয়ান আল-কে ডেকে তাকেও একশত উট দিয়ে দিলেন।
এভাবে রাসূল লাগলেন। মক্কাবাসীদের মাঝে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন করতে অথচ তারা ইসলামের জন্য আনসারদের ন্যায় ত্যাগ স্বীকার করেনি। আনসারদের ন্যায় জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এ তো কিছুদিন আগে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে।
আনসাররা সম্পদবন্টনের এ অবস্থা দেখে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন, 'আল্লাহ তার রাসূলকে ক্ষমা করুন! তিনি আমাদের রেখে কোরাইশদের মাঝে গনীমতের মাল বণ্টন করছেন। অথচ আমাদের তরবারি থেকে এখনো তাদের রক্ত ঝরছে!'
এ অবস্থা দেখে আনসারদের সরদার সাদ ইবনে উবাদা রাসূল-এর কাছে গিয়ে বললেন, 'আল্লাহর রাসূল! কিছু আনসারি সাহাবী যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতি দেখে মনে কষ্ট পেয়েছে।'
রাসূল আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'কেন?! তারা কেন কষ্ট পেয়েছে?!'
সাদ বললেন, 'আপনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে বণ্টন করেছেন। আরব গোত্রগুলোকে অনেক সম্পদ দিয়েছেন। অথচ আনসাররা সেখান থেকে কোনো অংশ পায়নি। এটাই তাদের মনোকষ্টের কারণ।'
রাসূল বললেন, 'সাদ! এ বিষয়ে তোমার অবস্থান কী?'
তিনি বললেন, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো আমার গোত্রেরই একজন।'
রাসূল অনুভব করলেন, বিষয়টির সমাধানে এমন একটি পদ্ধতি প্রয়োজন, যাতে আনসারি সাহাবীদের অর্থ-সমস্যার সমাধান না হলেও মনের কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
রাসূল বলো।' সাদকে বললেন, 'তোমার গোত্রের লোকদের সমবেত হতে। সকলে সমবেত হলে রাসূল উপস্থিত হলেন। তিনি প্রথমে আল্লাহ তাআলার হামদ পাঠ করলেন। এরপর বললেন, 'হে আনসারগণ! তোমাদের কিছু কথা আমার কানে এসেছে?'
উপস্থিত আনসারী সাহাবীগণ বললেন, 'আল্লাহর রাসূল! আমাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা কিছুই বলেননি। অল্প বয়সের কয়েকজন যুবক বলে ফেলেছে।'
রাসূল বললেন, 'হে আনসারগণ! তোমরা কি পথহারা ছিলে না? আল্লাহ কি আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন?'
তারা জবাবে বললো: 'অবশ্যই! আমাদের ওপর সকল অনুগ্রহ অনুদান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।'
'তোমরা কি পরস্পরে শত্রুতা পোষণ করতে না?-এরপর আল্লাহ কি তোমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করেন নি?'
'হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের ওপর আল্লাহ ও তার রাসূলের দয়া ও অনুগ্রহ সীমাহীন।'
এরপর রাসূল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পুরো মজলিস জুড়ে সবাই নীরব। রাসূল অপেক্ষা করছেন। অন্যরাও অপেক্ষা করছে।
নীরবতা ভেদ করে রাসূল বলে উঠলেন, 'হে আনসারগণ! তোমরা কি আমাকে উত্তর দেবে না?'
আনসারী সাহাবীরা বললেন, 'আল্লাহর রাসূল! আমরা কী উত্তর দেবো? যাবতীয় দয়া ও অনুদান তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেরই।'
রাসূল বললেন, আল্লাহর কসম! তোমরা ইচ্ছা করলে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত কিছু বলতে পারতে। যা বলতে, সত্যই বলতে এবং সবাই তা সত্য বলে মেনে নিতো।
তোমরা বলতে পারতে, 'মক্কাবাসী আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পর আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন। আমরাই তখন আপনাকে সত্যায়ন করেছি। আপনি উদ্বাস্তু অবস্থায় এসেছিলেন, আমরা আপনাকে স্থান দিয়েছি। আপনি বিতাড়িত ছিলেন, আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। আপনি নিঃস্ব ছিলেন, আমরা সহমর্মিতা দেখিয়েছি।'
এরপর রাসূল তাদের অনুভূতিকে জাগিয়ে তুললেন। তিনি বললেন, 'হে আনসারগণ! তোমরা পার্থিব তুচ্ছ সম্পদের জন্য আল্লাহর রাসূলের ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছো? আমি তো এ সম্পদ দিয়ে একটি কওমকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছি। আর তোমাদেরকে তোমাদের ইসলামের কাছে সোপর্দ করেছি। তোমরা জানো, কোরাইশরা এই তো কিছুদিন আগেও ছিলো মুর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। আমি শুধু চেয়েছি তাদেরকে ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে এবং তাদের অন্তঃকরণে ইসলামের প্রতি মায়া মমতা সৃষ্টি করতে।'
'হে আনসারগণ! তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তারা উট-বকরি নিয়ে বাড়ি ফিরবে, আর তোমরা বাড়ি ফিরবে আল্লাহর রাসূলকে সঙ্গে নিয়ে?!'
রাসূল ট্রি-কে নিঃসঙ্গ রেখে পেছনে ফিরে গেলো। মুসলমানদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল।
রাসূল সাহাবীদের দিকে তাকালেন। তার চোখের সামনে দিয়েই সকলে দৌড়ে পালাচ্ছে। রাসূল দিলেন, 'হে আনসারগণ!' উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজ
রাসূলের আহবানে সকলে 'লাব্বাইক' বলে সাড়া দিলেন। সাথে সাথে ফিরে এলেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন রাসূল-এর সামনে। শত্রুবাহিনীর প্রতিটি আঘাত ফিরিয়ে দিলেন ততোধিক আঘাতে। রাসূল-এর জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিলেন।
এবার কাফেররা পালাতে লাগলো। মুসলমানরা বিজয়ী হলেন।
যুদ্ধশেষে রাসূল-এর সামনে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ একত্র করা হলো। আনসাররা নীরবে তাকিয়ে থাকলেন। তাদের কারো কারো স্মৃতির এ্যালবামে ভেসে উঠলো মদীনায় রেখে আসা ক্ষুধার্ত পরিবার ও সন্তানদের মুখচ্ছবি। অনেকে এই যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে পরিবারের অভাব দূর হওয়ার মতো অংশ পাওয়ার আশা করছিলেন।
এমন সময় রাসূল আকরা ইবনে হাবিস আল-কে ডাকলেন। তিনি কিছুদিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। রাসূল তাকে একশত উট দিয়ে দিলেন। এরপর আবু সুফিয়ান আল-কে ডেকে তাকেও একশত উট দিয়ে দিলেন।
এভাবে রাসূল লাগলেন। মক্কাবাসীদের মাঝে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন করতে
অথচ তারা ইসলামের জন্য আনসারদের ন্যায় ত্যাগ স্বীকার করেনি। আনসারদের ন্যায় জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এ তো কিছুদিন আগে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে।
আনসাররা সম্পদবন্টনের এ অবস্থা দেখে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন, 'আল্লাহ তার রাসূলকে ক্ষমা করুন! তিনি আমাদের রেখে
অত্যন্ত দীনতা ও হীনতার সঙ্গে কাজ খুঁজতে লাগলো। প্রথম একজনের কাছে গিয়ে সে বললো, 'আপনার কাছে কোনো কাজ আছে? গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা, শস্যদানা মাড়াই ও পরিষ্কার করা, আগাছা পরিষ্কার করা, অথবা অন্য যে কোনো কাজের কথা বলুন, আমি করতে রাজি আছি।'
এ কৃষক একসময় ঐ সাবেক জমিদারের লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলো। তাই সে পাশার কথায় উত্তেজিত হয়ে বললো, 'আমি কাজ করাবো তোমাকে দিয়ে! আর লোক নেই? তুমিই তো সে অহঙ্কারী জমিদার! আল্লাহর লাখো শোকর! তিনি আমাদের দোয়া কবুল করে তোমাকে লাঞ্ছিত করেছেন।' এসব বলে সে তাকে বাগান থেকে তাড়িয়ে দিলো।
হতাশ মনে ভারী পাদুটো টানতে টানতে সে আরেকটি বাগানে প্রবেশ করলো। তার সাথে এ বাগানের মালিকেরও আছে কষ্টদায়ক স্মৃতি। তাই সেও প্রথম কৃষকের মতো তাকে তাড়িয়ে দিলো।
পাশা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। কিন্তু সে শূন্য হাতে সন্তানদের কাছে ফিরে যেতেও প্রস্তুত নয়। তাই সে নিজের ভাগ্যকে আরেকবার যাচাই করতে অনেক আশা নিয়ে তৃতীয় আরেক চাষীর বাগানে গেলো। চাষী তাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। এ চাষীও একসময় পাশার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলো।
পাশা চাষীকে খুব মিনতি করে বললো, 'আমি একটি কাজ খুঁজছি। আমার সন্তানেরা ক্ষুধার্ত। বাসায় খাবার বলতে কিছু নেই।'
চাষী তাকে কৌশলে লাঞ্ছিত করতে এবং প্রতিশোধ নিতে মনে মনে পরিকল্পনা করলো। তাকে সম্বোধন করে বললো, 'আসুন পাশা সাহেব! স্বাগতম আপনাকে। আপনার আগমনে আমার বাগান আজ ধন্য! আজ আমার চেয়ে বড় সৌভাগ্যবান আর কে আছে! মহান পাশা আমার বাগানে এসেছেন! আপনি বড় মহান! আপনি অভিজাত ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ!' এভাবে চাষী কথার যাদুতে পাশাকে সম্মোহিত করে ফেললো।
কিছুক্ষণ পর চাষী বললো, 'আপনাকে স্বাগতম পাশা! আপনি একবারে ঠিক সময়ে এসেছেন। আমার কাছে একটা কাজ আছে। কিন্তু কাজটা আপনার উপযোগী হয় কিনা...?'
পাশা জিজ্ঞেস করলো, 'কি কাজ'?
চাষী বললো, 'আমি জমিতে হালচাষ করবো। লাঙল টানতে তো দুটি ষাঁড় লাগে। আমার দুটি ষাঁড়ও আছে। একটা সাদা, আরেকটা কালো। ঘটনাক্রমে কালো ষাঁড়টা আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সাদা ষাঁড়টা তো একা একা লাঙল টানতে পারবে না। আমি চাচ্ছিলাম, আপনি যদি কালো ষাঁড়টার দায়িত্ব পালন করতেন! আপনি তো শক্তিশালী পুরুষ। উপরন্ত আপনি নেতা মানুষ, সবসময় সামনে থাকার লোক। সামনে তো আপনাকে ভালো মানায়!'
পাশা লাঙ্গল টানার জন্য সাদা ষাঁড়টার পাশে দাঁড়িয়ে গেলো! চাষী এসে সর্বপ্রথম সাদা ষাঁড়টাকে রশি দিয়ে বাঁধলো। এরপর পাশাকেও লাঙলের সঙ্গে বাঁধলো। এ সময় চাষী বারবার বলছিল: 'বাহ! চমৎকার পাশা! শক্তিতে-বীরত্বে, সৌন্দর্যে আপনার সমকক্ষ আর কে আছে!'
পাশাও ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলো!
অবশেষে তার কাঁধে রশি বাঁধা হলো। চাষীও মইয়ের ওপর চড়ে বসলো। তার হাতে ছিলো একটি চাবুক। সে হাল-চালনাতে আওয়াজ দিলো।- এরপর চাষী একটু পরপর ষাঁড়ের পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করলো। পাশাও চলতে শুরু করলো। চাষী বারবার বলতে লাগলো, 'বাহ পাশা! চমৎকার পাশা! অভিনব পাশা!'
এভাবে সে ষাঁড়ের পিঠে আঘাত করতে লাগলো আর বলতে লাগলো, 'আপনি তো বেশ শক্তিশালী পাশা ভাই! আপনি তো খুব কর্মঠ ও কাজের লোক!'
বেচারা পাশা এসব কাজে কখনও অভ্যস্ত ছিলো না। তবু সে কষ্ট করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাল টানলো।
কাজ শেষে চাষী তার বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে বললো, 'আল্লাহর শপথ! আপনার কাজ খুবই চমৎকার হয়েছে। আমার জীবনে এত সুন্দর দিন আর কখনো আসেনি।'
এরপর চাষী তাকে কিছু নগদ অর্থ দিয়ে বিদায় দিলো। পাশাও বাড়ির পথ ধরলো।
পাশা বাড়িতে সন্তানদের কাছে ফিরে এলো। তার উভয় কাঁধ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। পায়ের তালু ফেটে রক্ত ঝরছিলো। ঘামে ভিজতে ভিজতে কাপড়-চোপড় বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তখনও সে সম্মোহিত, চাষীর প্রশংসায় ব্যস্ত!
তার সন্তানরা তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'বাবা! কোনো কাজ পেয়েছো?' সে গর্বভরে উত্তর দিলো, 'আরে আমি পাশা! আমি কোনো কাজ পাবো না!' 'কী কাজ করছো, বাবা?' 'কী কাজ করেছি?... কী কাজ করেছি?...।'
এতক্ষণে সে তার চেতনা ফিরে পেলো। অবশেষে সে অনুভব করতে পারলো, সারাদিন সে কী কাজ করেছে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে বললো, 'আমি ষাঁড় হিসেবে কাজ করেছি'!
সিদ্ধান্ত...
সবচেয়ে প্রিয় কথাটি বাছাই করুন, যেমন ফল কেনার সময় সবচেয়ে ভালো ফলটি বেছে নেন।
অনুরোধ!
আপনার মতামত কমেন্টে জানান” বা “শেয়ার করে অন্যকেও জানার সুযোগ দিন